টুটু স্মৃতি চিত্রাংকন প্রতিযোগীতা-২০১৫ সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ (সিডিপি)’র প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত আশরাফ-উল-আলম টুটু’র অকাল প্রয়ানের পর থেকে প্রতি বছরই তার মৃত্যু বার্ষিকী পালন করে আসছে। ২০১১ সাল থেকে এই দিবসটি উপলক্ষ্যে সিডিপি প্রতি বছরই নিয়মিত টুটু স্মৃতি চিত্রাংকন প্রতিযোগীতার আয়োজন করছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে প্রয়াত আশরাফ-উল-আলম টুটু’র বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন সম্পর্কে জানাতে ভবিষ্যতে বৃহত পরিসরে চিত্রাংকন প্রতিযোগীতার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার আশা প্রকাশ করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে এর মাধ্যমে টুটু’র পরিবেশ বিষয়ক কর্মকান্ডকে তুলে ধরার পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষায় তাদের সচেতনতা তৈরী করবে যা সামগ্রিক পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখবে। এ বছরও ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ বিকাল ৩:০০টায় আবাহানী ক্রীড়াচক্র, স্টেডিয়াম চত্বর, খুলনায় (সার্কিট হাউজ সংলগ্ন) “টুটু স্মৃতি চিত্রাংকন প্রতিযোগীতা-২০১৫” এর আয়োজন করা হয়েছে।
প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহনের নিয়মাবলীঃ
০১. যে কোন বিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিশু শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেনীর শিক্ষার্থীবৃন্দ; ০২. পরিচয়পত্র সঙ্গে আনতে হবে, পরিচয়পত্র না থাকলে স্কুলের শিক্ষকদের দেয়া সনাক্তকরণপত্র; ০৩. প্রতিযোগীকে অবশ্যই রং, পেন্সিল ও আনুষাঙ্গিক উপকরণ সঙ্গে আনতে হবে; ০৪. সিডিপি শুধুমাত্র কাগজ সরবরাহ করবে; ০৫. বিকাল ২:৩০টার মধ্যে সকল প্রতিযোগীকে নিবন্ধন করতে হবে, এখানে কোন ফি প্রযোজ্য নয়।
পুরস্কার বিতরনীঃ
০১. ক্যাটাগরি অনুয়ায়ী প্রত্যেক গ্রুপের ৩ (তিন) জনকে পুরস্কার প্রদান করা হবে; ০২. প্রত্যেক গ্রুপ থেকে প্রথম ৩ (তিন)জনকে সনদপত্র প্রদান করা হবে; ০৩. সকল প্রতিযোগীকে সান্তনা পুরস্কার প্রদান করা হবে; ০৪. অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ বিচারক মন্ডলী দ্বারা বিচার কার্য পরিচালনা করা হবে।
আশরাফ-উল-আলম টুটু’র সংক্ষিপ্ত জীবনী (১৯৫৪-২০০৮)
জীবন মাত্রই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা। ‘একদিন এই দেখা হয়ে যাবে শেষ, পড়িবে নয়ন পরে অন্তিম নিমেষ। কবির বানীকে তো অস্বীকার করবার উপায় বা সাহস কারোই নেই। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও মন প্রবোধ মানে না। বোধকরি একারনেই কাছের কিংবা দুরের যাই হোক না কেন পরিচিত জনের অন্তিম যাত্রাকে সহজে মেনে নিতে মন সায় দেয় না কিছুতেই। আবার এমন কিছু মৃত্যু আছে যা হৃদয়কে বেদনার নীল দংশনে ক্ষত-বিক্ষত করে। সবার প্রিয় ও আমাদের শ্রদ্ধেয় আশরাফ-উল-আলম টুটু’র এই অবেলায় চলে যাওয়াকে কি কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না!! “টুটু’র কর্মই তাকে মানুষের কাছে আজীবন বাচিয়ে রাখবে”। আশরাফ-উল-আলম টুটু ১৯৫৪ সালের ৬ই অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৃতঃ আব্দুর রাশেদ এবং মাতার নাম মৃতঃ সুফিয়া বেগম। চার ভাই-বোনের মধ্যে আশরাফ-উল-আলম টুটু ছিলেন জৈষ্ঠ্য। জীবনের দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে গিয়ে ২০০৮ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে অকস্মাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মাঝ পথেই থেমে গেলেন। তার এই থেমে যাওয়া আমাদের সবার জন্যই এক অপুরণীয় ক্ষতির কারণ হলো। ব্যক্তির গন্ডি পেরিয়ে আশরাফ-উল-আলম টুটু হয়ে উঠেছিলেন সমষ্টির। জীবনের পরতে পরতে তিনি গভীরভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন এই দেশ এবং এই মাটির মানুষকে বাচাতে হলে নিরন্তর কাজ করে যেতে হবে। আশরাফ-উল-আলম টুটু’র সারা জীবনের কর্মকান্ডকে মূলত তিনটি ভাগে গুরুত্বসহকারে মূল্যায়ন করা দরকার। প্রথমতঃ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, দ্বিতীয়তঃ শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মানের জন্য তার রাজনৈতিক জীবন, তৃতীয়তঃ পরিবেশবাদী সংগঠক হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চল তথা বাংলাদেশের মানুষকে আসন্ন বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য কাজ করে যাওয়া। ১৯৭১ সালে ১৭ বছরের নবীন যুবক আশরাফ-উল-আলম টুটু দেশ মাতৃকার মুক্তির নেশায় আবির্ভূত হন অন্যরকম এক সংগ্রামী মানুষ হিসেবে। নিজের বুদ্ধি, চিন্তার প্রখরতা, আর অসাধারণ বিচক্ষণতার জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত দেরাদুন সামরিক একাডেমিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বি.এল.এফ-এর অন্যতম প্রশিক্ষক বনে যান তিনি। তরুন বয়সে বাংলাদেশের মানুষের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন দক্ষ যোদ্ধা হিসেবে যে ভূমিকা তিনি রেখেছেন আমৃত্যু সে ভুমিকায় তিনি ছিলেন অবিচল। তিনি উপকূলীয় অঞ্চলের নিপীড়িত মানুষ, ভূমিহীন, আদিবাসীসহ অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরণ সংগ্রাম করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের জন্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার সাথে সম্পৃক্ত হন তিনি। মার্কস-লেলিনবাদের সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে শ্রমিক শ্রেনীর রাষ্ট্রকায়েমের জন্য সাম্যবাদী দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি এ দলটির খুলনা জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ সালের শেষের দিকে কমিউনিস্ট লীগ ও সাম্যবাদী দল একীভূত তথা বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের নের্তৃতে অবতীর্ণ হন এবং পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালের প্রথম দিকে বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ ওয়ার্কার্স পার্টি একীভূত হয়ে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের জেলা কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন সে সময় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের আট দলীয় জোটের খুলনার শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের ভুমিকায় দেখা যায় তাকে। আজ আমরা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয় নিয়ে যে কথা খুব জোরেশোরে উচ্চারিত হতে দেখছি তা অনেক আগেই তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন। আশির দশকেই আশরাফ-উল-আলম টুটু বুঝেছিলেন জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বগ্রাসী থাবা ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। যখন তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেন তখন অনেকের কাছেই বিষয়টির প্রভাব সম্পর্কে খুব একটা জানা ছিল না। নিঃসন্দেহে তাই বলা যায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃত। ১৯৯৭ সালে কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ (সিডিপি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জীবন মান উন্নয়নের লক্ষ্যে এ অঞ্চলে মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং উপকূলীয় পরিবেশ সুরক্ষার লক্ষ্যে নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, সুন্দরবন, জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্প পর্যালোচনা, কৃষি, অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ, আদিবাসী, শিশু শ্রম, নারী অধিকার প্রভৃতি বিষয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। খাস জমি, কৃষক ও ভূমিহীনদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বিল ডাকাতিয়া ও ভবদহের কৃষক আন্দোলন, সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা ও কালিগঞ্জ থানার ভুমিহীন আন্দোলনকে সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে ঐ অঞ্চলের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তার লেখা ৪০টিরও অধিক গবেষণাভিত্তিক প্রকাশনা দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। তাছাড়া তার নিজের লেখা ও সম্পাদনায় প্রায় তিন শতাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আশরাফ-উল-আলম টুটু সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ফিলিপাইন, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, ম্যাক্সিকো, ভারত ও নেপালসহ পঁচিশটিরও বেশি দেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ফোরামে অংশগ্রহন করে এদেশের মাটি ও মানুষের পক্ষ থেকে জোরালো ভূমিকা পালন করেছেন। তার মহিমানিত্ব ব্যক্তিত্ব, ভাব-গাম্ভীর্যতা, দৃঢ়চেতা মনোভাব, অধ্যাবসায়ী, স্বল্পভাষী, আকর্ষণীয় চেহারার প্রতি সবাই আকৃষ্ট হত। তিনি সহজেই পরামর্শ ও উপদেশ দিয়ে সবাইকে তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা প্রতিভাকে বিকশিত করতেন। বই পড়তে যেমন ভালবাসতেন তেমনি ছিলেন প্রকৃতি প্রেমী। শখ ছিল পশুপাখি লালন পালন করা ও তাদের ভাষা বোঝার। নিজের প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও পরামর্শ দিতেন। মুলতঃ তিনি সামগ্রিকভাবে সবাইকে নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতেন। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবার জন্যে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, দক্ষতা ও অন্যান্য সকল উপকরণ ইতোমধ্যে তিনি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই কর্মবীর মানুষটির অকাল মৃত্যুতে বাংলাদেশের জনগন বঞ্চিত হল। আশরাফ-উল-আলম টুটু শিখিয়ে গেছেন তৃণমূল জনগোষ্ঠীর সাথে কিভাবে কাজ করতে হয়। তিনি আমাদেরকে পথ দেখিয়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়। তিনি শিখিয়ে গেছেন কিভাবে সংকটের বেড়াজাল পেরিয়ে এই জনপদের মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াবে। আশরাফ-উল-আলম টুটু আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার স্বপ্ন বেঁচে আছে। তার আদর্শ আজও আমাদের চলার পথকে সুগম করে দেয়। চলমান সংকটে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল তার নের্তৃত্বের, কিন্তু চাইলেইতো সব আশা পুরণ হয় না। তেমনি আমরাও আর শত চেষ্টা করেও ফিরে পাব না তাকে। তবে এ মহান মানুষটির কর্মময় জীবন, তার শিক্ষা, আদর্শ আমাদের আজও পথ দেখিয়ে চলছে। সমূদ্রের বাতি ঘরের মত দূর থেকেই তিনি আমাদের আজও পরিচালিত করে। তার স্মৃতির প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে আজ থেকে আমরা এগিয়ে যাই তার অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করতে। তা হলেই এ কর্মবীরের আত্নায় শন্তি পাবে।
রচনায়ঃ সিডিপি’র কর্মীবৃন্দ
|